‘Feminism’- যাকে আমরা সোজা কথায় বলি নারীবাদ।পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বেঁচে, নারীর ক্ষমতায়নের এক মতবাদ।আজকের এই ২০১৮ তে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে মানুষ সচেতন হয়েছে। চলছে তর্ক বিতর্ক এবং লেখালেখি। বেশ কিছু মানুষ আবার নারীবাদী আন্দোলনের কান্ডারী বা অংশীদার বলে তাদের মনে করে তাদের তথাকথিত শিক্ষার দর্পটাকে একটু বাজিয়ে নিতে চায় সমাজের কাছে। যাই হোক, কিন্তু কষ্ট হয় কখন জানেন? যখন নিজের মা কে প্রকাশ্যে, যদিও অত্যন্ত সাদর সম্ভাষণে অপমানিত হতে দেখি। যখন দেখি আমার মাকে সবাই আদুরে কণ্ঠে রত্নগর্ভা বলে ডাকছে। উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়ার পর আমার সেই একান্ত আপন নিজস্ব মায়ের স্ব-সত্ত্বাটাই কোথায় যেন’উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম গ্রন্থনের মা’ এই পরিচিতির আড়ালে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে।সংস্কৃতি চর্চায় জীবনযাপন করা মায়ের নিজস্ব পরিচিতি এখন পুনর্নির্মিত হয়েছে আমার পরিচয়ে। যা একজন শিক্ষিত ছেলে হিসেবে লজ্জার।আচ্ছা,ভেবে বলুন তো, রত্নগর্ভা শব্দটির কোন পুংলিঙ্গ রয়েছে কি?নেই, কারণ অত্যন্ত প্রগতিশীল সমাজেও আজ নারীকে ধরে নেওয়া হয় একটা ‘Container’ হিসেবে। যেন কোন মেয়ের পরম এবং চরম কাজই হল তার জরায়ু থেকে এক উত্তম উপজাত ( পড়ুন সন্তান) নির্গত করা যা পরবর্তীকালে তার মাতৃত্বের গুনমান বৃদ্ধি করবে। মায়ের স্নেহ, মায়ের ভালোবাসার কোন মূল্যই নেই এখানে। কারণ মাতৃমনকে নয় বরং তার শরীরের উত্তম উপজাত প্রসব করার ক্ষমতাকেই গুরুত্ব দেয় আজকের বিশ্বায়নের জোয়ারে স্নাত এই পৃথিবী।পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এ এক অপসংস্কৃতি।
বাঙ্গালী হিসেবেই আমাদের মানে-অভিমানে, শয়নে-স্বপনে মিশে আছেন যিনি তিনি তো রবীন্দ্রনাথ,তাই মাকে রত্নগর্ভা বলা হলে যতটা না কষ্ট হয় তার থেকেও বেশী বেদনা হয় এই ভেবে যে যেই জাতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পেয়েছে তারও আজ এই হাল? চিরকাল রবীন্দ্রনাথ কলম তুলে নিয়েছেন,সমাজে নারীর সাম্যের সমতা বিধানে।চিত্রাঙ্গদা তে তাই তিনি পরিশেষে বলেছেন,’’আমি চিত্রাঙ্গদা…নহি দেবী,নহি সামান্যা নারী/পূজা করি রাখিবে উর্দ্ধে সে নহি নহি হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে,সে নহি নহি।’’- নারীর স্বপরিচিত স্বপক্ষে লেখা এক অসামান্য বয়ান। আবার ‘ঊর্বশী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন-
‘নহ মাতা,নহ কন্যা,নহ বধু,সুন্দরী রূপসী’-সত্যি কারও মা, কারও স্ত্রী বা কারও কন্যা হিসেবে নয়, এক নারী বাঁচবে তার নিজস্ব পরিচয়ে।আবার ‘নষ্টনীড়’ থেকে ‘ঘরে-বাইরে’ এমন লেখনীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের বহু সামাজিক নিয়ম (Social Norms) এর মূলে কুঠারাঘাত করেছেন।ঘরে বাইরে তে যেখানে আমরা দেখি কীভাবে বিমলা তার পারিবারিক ও সাংসারিক দমনকে উপেক্ষা করেও সন্দীপের মধ্যে খুঁজে পায় প্রকৃত ভালোবাসার উষ্ণতা।মূলত,তাঁর লেখার প্রতিটি স্তরে আমরা খুঁজে পাই নারীর ক্ষমতায়নের বার্তা, সমাজে নারীর সমতার কাহন। মনে পড়ছে, কিছুদিন আগেই ‘মালালা ইউসুফজাই’ Feminism প্রসঙ্গে বলেছেন- Feminism is just another word for equality’’ দেখুন, বিংশ শতাব্দীতে যে কথা মালালা ইউসুফজাই বলছেন তাই বহু বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখার মাধ্যমে সমাজের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
তবে এসব দেখবার পর যখন রত্নগর্ভা হিসেবে মাকে পরিচিতি পেতে দেখি তখন কোথাও যেন এই সমাজে লিঙ্গের আধিপত্যের প্রচ্ছন্ন দাপটের আঁশটে গন্ধে আমার শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। মায়ের মমত্ব,মায়ের স্নেহের দাম দিতে না পারলে, নারীকে তাঁর মতো নিজস্ব মানবী হিসেবে বাঁচতে না দিলে আমার মতে আজকের দিনের সমস্ত কবি স্মরণ ম্লান হয়ে যাবে। রবিঠাকুরকে স্মরণে রেখে মায়ের মাতৃত্বের প্রকৃত ও যথাযথ সম্মান করতে পারলেই বলা যাবে
‘এ পথে আলো জ্বেলে,এ পথেই ক্রমমুক্তি হবে’
গ্রন্থন সেনগুপ্ত
সম্পাদকের কথা-
‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ ,সুন্দরী রূপসী’ রবীন্দ্রনাথের এই শব্দগুলিতে নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রকাশ। ব্যক্তিগত জীবন আন্দোলিত করা এক পরিস্থিতিতে নারীর ভূমিকা নিয়ে সমাজের দ্বিচারিতা ও সেই দ্বিচারিতার দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করার সময় কেমন করে রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন একান্ত আশ্রয়, বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে গ্রন্থন সেনগুপ্তের লেখায় তারই প্রকাশ।
লেখক পরিচিতি-
গ্রন্থন সেনগুপ্ত কৃতী ছাত্র। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল থেকে ২০১৮-র উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী। মিউজিয়ানা কালেক্টিভের পাঠকদের জন্য এটিই তার প্রথম রচনা।