যে সময় দেশ ছাড়ি, ২০১৪,তখনও সিডি চলে পাড়ার অনুষ্ঠানে ।মাইক্রো চিপের খ্যাতি আস্তে আস্তে বাড়ছে।mp3 কুড়ি টাকায় যাবতীয় পুজোর গান শুনিয়ে দিচ্ছে। কমপক্ষে ১৬ টা সিডি,যার পেছনে খুব কম করে ধরলে, মার্কেটিং বাদে শুধু production cost ১৬লাখ টাকা, শুনে ফেলা যাচ্ছে কুড়ি টাকায়।তবুও কিন্তু গান যে হিট হচ্ছে বলা যাবেনা।
অন্যদিকে f.m. চ্যানেলে বাজানোর জন্য অনেক খেলা চলছে। একটা গান অন্তত বাজবে এই আশায় কি হচ্ছে?
f.m. এর সঞ্চালকের কথায় সুরে গান করছে নতুনেরা।সহজ পথ।গান যেমনই হোক,সে গান গাইতে পারুক না পারুক,তার তৈরি গান গাইলেই ঠাঁই হবে সারাদিনে একবার f.m. এ।তখন বাসে, দোকানে,এমন কি বাড়িতেও রেডিও আবার বেজে উঠত।বহু গান কিন্তু f.m. এ বেজে বেজে হিট,অথচ সিডি বা ক্যাসেট বিক্রি হয়নি। এ আমার নিজে চোখে দেখা।ভালো মন্দ পরের কথা।ছবিটা কিন্তু এইরকম। তার মধ্যে রমরমিয়ে চলছে কেবল মিউজিক কোম্পানি গুলো।যারা সিডি বের করবে, কিছু দোকানে দেবে (???!!!!),এবং যদি কদাচিৎ বিক্রি হয়েই যায়,লাভটা নিজেরাই খাবে।কারণ রয়েলটির যুগ নেই আর।তুমিই গান produce করবে,তুমিই কোম্পানি কে টাকা দেবে,তুমিই সে গান হিট হলেও এক পয়সা পাবেনা।কারণ already তোমার হাতে পঞ্চাশ কি একশো সিডি গুঁজে দিয়েছে তারা।তুমি বোন,এগুলো বেচে টাকা তুলে নিয়ো কিছু। নামীদামি দের কথা জানিনা।নতুনদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম।আমি ছাড়া বোধহয় এমন নাম খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যে সে সময়ে একটা সিডি অন্তত বের করেনি।আমি কিছু রাগ রেকর্ড করেছিলাম, কিন্তু নিজের গান নিজেরই পছন্দ হয়নি, তাই ওপরকে শোনাবার ঝুঁকি আর নিইনি। তাছাড়া অর্থের বিনিময়ে কোম্পানি থেকে গান বের করা,কোথায় যেন সম্মানে লেগেছিলো।আমার সিডি বেরোলেই, বিক্রির টাকায় আমি ধনকুবের হয়ে উঠবো এমনটাও মনে হয়নি। আজও হয়না।
তো, এই গেলো তখনকার ব্যাপার।
যাদের গান দু’একটা কানে ধরে গেলো, গেলো।কিন্তু,ওই পর্যন্তই।তার মানেই কিন্তু এই নয় যে সে শিল্পীর পরের সিডিই হইহই করে কিনতে ভিড় হবে দোকানে। হাজার হাজার ভুঁইফোড় মিউজিক কোম্পানি আর শিল্পী গজিয়ে উঠল। গান আসতে লাগলো থরে থরে।
পয়সা উড়লো।কিন্তু ফিরলো না।
গানমেলা শুরু হল।আবার এক মওকা,পয়সা লোটার।গানমেলায় সিডি বের করো, বিক্রি হবে।
কিস্যু হয়নি।
পয়সা পকেটে ভরেছে কোম্পানির। শিল্পী আঙুল চুষেছে। নিজের। সে সিডি পরের বছর দশ টাকায়,পিচবোর্ডের বাক্সে।হাত ঢুকিয়ে খুঁজে বের করে আনতে হবে।
ক্রমশ, যারা খ্যাতিমান। যাদের হাতে বাংলা গান তখন, তারাও হাত তুলে নিলেন।তারা কেবল অনুষ্ঠান করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখলেন।কারণ ছিলো, আছে এখনও।
কার জন্য নতুন গান আনবেন?
মানুষ শোনেনা নতুন গান।
কেন?!
আর হ্যাঁ,অনেকেই একজনের বাংলা গানের দিকে সরে বাঁচতে শুরু করলেন। পুরো না হলেও অনেকাংশে। যার গানের কোনও অবতরণ নেই,শুধু উত্তরণ আছে। সেই অলৌকিক রচয়িতা কে? কে আবার,শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ইমন রাগের মতো,রবি ঠাকুর। ফুরোয় না।
কিন্তু,নতুন গান কি থেমে গেলো তাই বলে?
তবু, কেন শ্রোতারা প্রশ্ন ছোঁড়েন, ‘আগের মতো গান হচ্ছেনা’? সত্যিই কি তাই?
শোনেনা কেউ?
কিন্তু কেন শোনেনা?
শিল্পী দোষী? তিনি দিতে পারছেন না?
নাকি শ্রোতার মন বদল?হলেও শুনছেন না।
অনেক প্রশ্ন। অনেক দিকে।
অনেক উত্তর। অনেক দিকে।
বাক বিতর্ক বেড়েছে।হতাশা বেড়েছে।বাংলা গানের কি হয়েছে? অসুখ। দুরারোগ্য ব্যাধি।
আমি নিজে সে এলাকাতেই নেই।শিল্পী হিসেবে।
কিন্তু বাংলা গানকে ভালো তো বেসেছি।শ্রোতা হিসেবে।মায়ের মতো জেনেছি।যার স্তন্য পান করে মানুষ হয়েছি। উত্তর খুঁজেছি। খুঁজে চলেছি।
তবে একটা কাজ কিন্তু নিয়মিত করে গেছি। নতুন বাংলা গান শুনে গেছি। সে যেখানেই থাকি। ভালোবেসেছি কখনো। কখনও ভাবতে বসেছি,কেন ভালো লাগাতে পারছিনা? ক্ষত অনেক গভীরে, মনে হয়েছে আমার।
দরজা খুলেছে অনেক, গান শোনবার। ঠিকানা হারিয়ে গেছে…….
সম্পাদকের কথা-
বাংলার সংগীত চর্চা অধ্যায়ের কয়েক পাতা উল্টালে ছায়াছবির গানের পাশাপাশি স্বতন্ত্র বাংলা প্রযোজনারগুলির উজ্জ্বল উপস্থিতিও নজর এড়ায় না। এরপর সময় পেরিয়েছে, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে তা অপব্যবহারের মাত্রাও বেড়েছে৷ বাংলার ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক জগতে এর প্রভাব এবং বাংলা গানের বর্তমান অবস্থাটা ঠিক কেমন তার একটি স্পষ্ট ছবি আমাদের পাঠকদের জন্য লিখলেন পন্ডিত মানস চক্রবর্তীর শিষ্য শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী হলেও বাংলা গান রচনায় তাঁর সমান আগ্রহ। দেশে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদেশের মাটিতে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট ফর আর্টস এণ্ড কালচার্সে অধ্যাপনা করেছেন।
Author Profile

Latest entries
Faces and Places2018.09.08দোষ কারো নয় গো মা
Faces and Places2018.09.01পয়সা উড়লো, কিন্তু ফিরলো না